অন্ধবধূ (যতীন্দ্রমোহন বাগচী)

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য কবিতা | - | NCTB BOOK
365
365

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!

আস্তে একটু চল না ঠাকুরঝি –

           ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?

তাইতো বলি, বসে দোরের পাশে,

রাত্তিরে কাল— মধুমদির বাসে

          আকাশ-পাতাল— কতই মনে হয়।

জ্যৈষ্ঠ আসতে ক-দিন দেরি ভাই -

আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?

অনেক দেরি? কেমন করে হবে!

কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,

           দখিন হাওয়া – বন্ধ কবে ভাই;

দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে -

শ্যাওলা-পিছল – এমনি শঙ্কা লাগে,

           পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!

মন্দ নেহাত হয় না কিন্তু তায়-

অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যায় !

দুঃখ নাইকো সত্যি কথা শোন,

অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?

বাঁচবি তোরা – দাদা তো তোর আগে?

এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,

বাড়ি আসার পথ খুঁজে না পাবে -

দেখবি তখন - প্রবাস কেমন লাগে?

‘চোখ গেল’ ওই চেঁচিয়ে হলো সারা ।

আচ্ছা দিদি, কী করবে ভাই তারা-

জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !

কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার – ছাই!

কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,

        কতক তবু কমত যে তার শোক ।

‘চোখ গেল’— তার ভরসা তবু আছে—

         চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে!

টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি-

সেই তো ফিরে যাব আবার বাড়ি,

          একলা-থাকা- সেই তো গৃহকোণ—

তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে

দুটো যেন প্রাণের কথা বলে—

দরদ-ভরা দুখের আলাপন;

পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো

ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!

common.content_added_by

কবি পরিচিতি

201
201

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্ম ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর নদীয়া জেলার জামশেদপুর গ্রামে । পল্লি-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের রচনার মতো তাঁর কবিতাও নিসর্গ-সৌন্দর্যে চিত্ররূপময়। রচনায় গ্রামবাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রাম-জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ-সরল ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে : লেখা, রেখা, অপরাজিতা, নাগকেশর, বন্ধুর দান, জাগরণী, নীহারিকা ও মহাভারতী। ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টিকা

280
280

ঠাকুরঝি – ননদ, স্বামীর বোন, শ্বশুরকন্যা। মধুমদির বাসে মধুর গন্ধে মোহময় - সুগন্ধে আচ্ছন্ন। আকাশ-পাতাল - নানা বিষয়, নানান ভাবনা-অনুভাবনা অর্থে ব্যবহৃত। জ্যৈষ্ঠ আসতে ক-দিন দেরি ভাই- একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের অনুভবের অসাধারণ এক জগৎ আলোচ্য অংশে ব্যক্ত হয়েছে। প্রকৃতির বিচিত্র রঙের ধারণা ও অনুভবে এই অন্ধবধূ সমৃদ্ধ। সেই জ্ঞান ও অনুভব থেকে সে জেনে নিতে চায় ঋতুর বিবর্তন। অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যাক -অন্ধবধূ অনুভবঋদ্ধ মানুষ অর্থাৎ তার অনুভূতি শক্তি প্রখর। আত্মমর্যাদা বোধেও সে সমৃদ্ধ। কিন্তু সে অন্ধ । এই অন্ধত্বের কষ্ট সে গভীরভাবে অনুভব করে। দীঘির ঘাটে যখন শেওলা পড়া পিছল সিঁড়ি জাগে, তখন সে পিছল খেয়ে জলে পড়ে ডুবে মরার আশঙ্কা প্রকাশ করে। সে এও অনুভব করে যে, ডুবে মরলে অন্ধত্বের অভিশাপ ঘুচত। কিন্তু কবিতাটির চেতনা থেকে মনে হয়, অন্ধবধূ নৈরাশ্যবাদী মানুষ নয়। জীবনের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ আছে। চোখ গেল – পাখি বিশেষ। এই পাখির ডাক ‘চোখ গেল' শব্দের মতো মনে হয়। কাঁদার সুখ -মানুষ দুঃখে কাঁদে, শোকে কাঁদে। কিন্তু কান্নার মধ্য দিয়ে তার দুঃখ-শোকের লাঘব ঘটে।
 

common.content_added_by

পাঠ পরিচিতি

233
233

সমাজ দৃষ্টিহীনদের অবজ্ঞা করে। দৃষ্টিহীনেরা নিজেরাও নিজেদের অসহায় ভাবে। কিন্তু ইন্দ্ৰিয়সচেতনতা দিয়ে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব। পায়ের নিচে নরম বস্তুর অস্তিত্ব, কোকিলের ডাক শুনে নতুন ঋতুর আগমন অনুমান করা, শ্যাওলায় পা রেখে নতুন সিঁড়ি জেগে ওঠার কথা বোঝা দৃষ্টিহীন হয়েও সম্ভবপর। তাই দৃষ্টিহীন হলেই নিজেকে অসহায় না ভেবে, শুধুই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে আপন অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করা প্রয়োজন। বধূটি চোখে দেখতে পায় না । কিন্তু অনুভবে সে জগতের রূপ-রস-গন্ধ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। কবিতাটিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা সংবেদনশীল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion